বাংলাদেশ-মালদ্বীপ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, পারস্পরিক বিশ্বাসের চিহ্ন

By Admin Published in অনুবাদ August 18, 2022

বাংলাদেশ-মালদ্বীপ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, পারস্পরিক বিশ্বাসের চিহ্ন

বাংলাদেশ-মালদ্বীপ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ; পারস্পরিক বিশ্বাস, সম্মান এবং সহযোগিতার চিহ্ন

পটভূমি

বাংলাদেশের বিদেশ নীতি বা পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক বিষয়টি সংবিধানের ২৫ নম্বর আর্টিকেলের উপর ভিত্তি করে। 

বাংলাদেশ এবং মালদ্বীপ এ দুই দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পারস্পরিক পরিবেশগত, সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতির দিক থেকে ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও সম্পর্ক সুন্দরভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ‌১৯৭৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর আজ অব্দি পারস্পরিক সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। 

২০০৮ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে মালদ্বীপ তাদের হাইকমিশন স্থাপিত করে। বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার নিমিত্তে গড়ে ওঠা দুই দেশের সম্পর্কের কারণে ২০১১ সালে মালদ্বীপ বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত সকল পূর্ণরূপ থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করে নেয়। যা এই দুই রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরো জোরদার করে। 

তবে ২০১৪ সালের মার্চ মাসে মালদ্বীপ সরকার বাংলাদেশে অবস্থিত হাই কমিশনের সকল কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়। সে সময় মালদ্বীপের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাজেট ৪০ শতাংশ কমানো হয়েছিল। যার ফলে বাংলাদেশ থেকে তারা হাইকমিশন সরিয়ে নেয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে হাইকমিশনের ভাড়া দেয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলেও মালদ্বীপ অত্যন্ত সৌজন্যতার সঙ্গে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। 

এমন পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ১০০ হাজার লিটার বিশুদ্ধ পানি বাংলাদেশ থেকে মালদ্বীপে পাঠায়। সে সময় একটি দুর্ঘটনায় মালদ্বীপের ডিস্যালিনেশন প্লান্টটির সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর অর্থনৈতিক সংকটে বন্ধ করে দেয়া ঢাকাস্থ মালদ্বীপ হাই কমিশনের সকল কার্যক্রম আবারো দু'বছর পর পুনরায় চালু করা হয়। 

সম্পর্ক জোরদার

দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটি রাষ্ট্র পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে সম্পর্কে নতুন যুগের সূচনা করেছে। বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশি প্রবাসী মালদ্বীপে সম্মানের সাথে কাজ করছে। যার ফলে বাংলাদেশে রেমিটেন্স বিপ্লব ঘটেছে। ২০০৯ সালের অস্থায়ী ভিত্তিতে ১৬ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশী মালদ্বীপে কর্মরত ছিল। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ০.৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। এছাড়াও ১.৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ ওষুধ রপ্তানি করা হয় মালদ্বীপে। 

মানব সম্পদ, মৎস্য, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার এই সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করে। 

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতির ঢাকায় আগমন এই সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে। 

সে সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের উল্লেখ করে গত এক দশকের বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের প্রশংসা করেন। এছাড়াও ভারত মহাসাগরের নিচু দেশ দুটির জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করার উপর জোর দিয়েছিলেন। 

এছাড়াও প্রেসিডেন্ট সলিহ মালদ্বীপে অবস্থানরত বাংলাদেশী প্রবাসী যারা মালদ্বীপের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে কাজ করছেন তাদের কাজের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের প্রশংসা করেন। 

"বিশেষত অর্থনৈতিক কূটনীতি সফল পরিচালনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত
 "ব্লু ইকোনমি" ;সরকারি, বেসরকারি খাতে এবং দক্ষ কর্মীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন হিসেবে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যে নাগরিক সমাজ তৈরি করবে”

বাংলাদেশ এবং মালদ্বীপ জড়িত হলেও একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এই বিষয়ে যে, একটি যৌথ সমন্বয় কমিশন থাকবে যা উভয় রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র অফিস কর্তৃক নির্দেশনা নিয়ে মৎস্য ও শিকার এবং সাংস্কৃতিক আদান প্রদান নিয়ে কাজ করবে। যা ২০২২ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। 

দ্রুত বৈশ্বিক অবকাঠামগত পরিবর্তনের এই সময়ে এসে মালদ্বীপ এবং বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক দৃঢ় করার বিষয়টি অন্যান্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। 

আমি মনে করি, উভয় রাষ্ট্রকে পারস্পরিক সর্বোচ্চ স্বার্থ বিকশিত করতে এবং অর্থনৈতিক লাভ রক্ষা করতে আরো সৃজনশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 

পারস্পরিক সহযোগিতার সম্ভাব্য ক্ষেত্রসমূহ 

মালদ্বীপে বাংলাদেশী চিকিৎসক এবং নার্সরা কর্মরত আছেন। সেখানকার সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বলয়ে নিয়ে আসতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বাংলাদেশী চিকিৎসক ও নার্সরা। ১০০ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী উচ্চতর পড়াশোনার জন্য মালদ্বীপে অবস্থান করছেন।‌ এই সংখ্যা আগামীতে আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ‌ আনুমানিক ৬০ থেকে ৮০ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক বর্তমানে মালদ্বীপে কাজ করছে। অবশ্য বাংলাদেশের এক্ষেত্রে মালদ্বীপকে সহযোগিতা করার জন্য পর্যাপ্ত সক্ষমতা রয়েছে। মালদ্বীপকে দক্ষ শ্রমিক দেওয়ার মতো সামর্থ্যবান রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

সুতরাং এই সম্পর্কের ভিত আরো মজবুত করতে মানবসম্পদ, মৎস্য, স্বাস্থ্য এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রগুলোতে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে সম্পর্ক আরো জোরদার করা সম্ভব। সরাসরি আকাশ পথ ও নৌ পথে মালদ্বীপের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। 

যেহেতু পর্যটন বাংলাদেশ এবং মালদ্বীপ উভয় রাষ্ট্রের জন্যই একটি সম্ভাবনাময় খাত, তাই বিনিয়োগকারী এবং ব্যবসায়ীদের উচিত দুই রাষ্ট্রের বিদ্যমান সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে একসঙ্গে পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করা। মালদ্বীপও বাংলাদেশ থেকে ওষুধ, তৈরি পোশাক, সিরামিকসহ আন্তর্জাতিক মানের বাংলাদেশি পণ্য আমদানি করার বিষয়টি নিবিড়ভাবে ভেবে দেখতে পারে।‌ বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যে এ ধরনের সংযোগ অবশ্যই সহায়ক হবে। 

ভবিষ্যতে দুই রাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রসারিত করা, সরাসরি বায়ু এবং জলপথ স্থাপন বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যকার বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক আরও জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এবং এটি সময়ের দাবি । 
 
মালদ্বীপ ও বাংলাদেশকে বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। বিনিয়োগ, উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের সহযোগিতার জন্য একটি সক্ষম পরিবেশ তৈরি করাও জরুরি। 
এছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রগুলির মধ্যে কৃষি, পর্যটন, মৎস্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং ঔষুধ উল্লেখযোগ্য। 

“দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার নিশ্চিত করা হয়েছে, সহযোগিতার নতুন যুগে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পরিচালনা করবে"

কিভাবে পারস্পরিক সুবিধার জন্য দুই দেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সুসংহত করতে পারে?

ব্লু ইকোনমির প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রেখে উভয় রাষ্ট্রের নাগরিক সমাজের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি করা এবং অশিক্ষিত জনশক্তি সরকারি ও ব্যক্তিগত সেক্টরে সেতুবন্ধন তৈরি করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। এই পূর্বশর্ত হল বাণিজ্য, বিনিয়োগ বোঝা এবং আলোচনা করা এবং জাতীয় উন্নয়নের দৃষ্টিকোণ থেকে অন্যান্য অর্থনৈতিক বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার পর দেশের শক্তি, সীমাবদ্ধতা, সুযোগ এবং হুমকির বিষয়গুলো বিবেচনা করা।  আমরা চাই বাংলাদেশ হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাক
 মালদ্বীপের সাথে। উদাহরণস্বরূপ, মালদ্বীপ সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ করেছে একটি দীর্ঘমেয়াদী ঋণের জন্য।‌ 
 
বাংলাদেশ সরকার ঋণের আবেদনটি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে। সম্প্রতি ২০২১ সালে বাণিজ্য, পর্যটন, মৎস্যসম্পদ, সাস্থ্যসহ আরো চারটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে
। পাশাপাশি এই সম্পর্ককে আরো জোরদার করতে উভয় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে কথা চলছে। আমাদের একটি অগ্রগতির দৃষ্টিভঙ্গি থাকা দরকার যাতে আমরা অতীত ঐতিহ্যের সাথে আসতে পারি। এবং অবশ্যই কূটনীতির চেতনার উপর ভিত্তি করে। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ এগিয়ে যাওয়ার জন্য এই গতি ধরে রাখবে। 

২০২১ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মালদ্বীপ সফরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাঁচ দিনের সেই সফর স্পষ্টভাবেই দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, পর্যটন শিল্প এবং মালদ্বীপে বসবাসরত বাংলাদেশীদের সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সেই সফর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ ছিল। 

সেই সফরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীর ১৩ টি সাজোয়াযান বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা বিভাগে উপহার দেওয়া হয়েছিল। 

অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী এই দেশটি আরো রিসোর্ট তৈরি করতে চাচ্ছে। যেখানে বাংলাদেশীদের জন্য নতুন শ্রমবাজার খোলার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সেই সফরে দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল স্বাস্থ্য এবং যুব ও ক্রীড়া উন্নয়ন নিয়ে। এছাড়া মালদ্বীপের সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে আরও একটি চুক্তি নবায়ন করা হয়েছিল। 

মহামারীর পর মালদ্বীপ তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ব্যাপক রদবদল এনে সংশ্লিষ্ট খাতের উন্নতিতে মনোনিবেশ করছে। দেশটি বাংলাদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্স নিতে চায়। সুতরাং বাংলাদেশের সঙ্গে মালদ্বীপ দীর্ঘমেয়াদি বন্ধুত্বের সম্পর্ক অটুট রাখতে চায়, এটা স্পষ্ট।

বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সবমিলিয়ে মাত্র ৭ মিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে বাংলাদেশ মালদ্বীপ থেকে ৩ মিলিয়ন মূল্যের আমদানি করে এবং মালদ্বীপে রপ্তানি করে প্রায় ৪ মিলিয়ন সমমূল্যের পণ্য।  
 
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনার সাথে মিল রেখে দেশটির সাথে নতুন করে কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। দেশের সংবিধানের মূলনীতি, "সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়।" 

সুতরাং বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ উভয় রাষ্ট্রেই
 আরো ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 

লেখক: ড. মুহাম্মাদ তারিকুল ইসলাম
সহযোগী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (সরকার ও রাজনীতি বিভাগ) 
ভিজিটিং স্কলার, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, ও সোয়াস ইউনিভার্সিটি 


মূল, ড. তারিকুল ইসলাম
সহযোগী অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

অনুবাদ, সুফিয়ান ফারাবী
সরকার ও রাজনীতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়