কপ-২৬ বিশেষ কারণেই অন্য যেকোনো সম্মেলন থেকে আলাদা

By Admin Published in অনুবাদ August 18, 2022

কপ-২৬ বিশেষ কারণেই অন্য যেকোনো সম্মেলন থেকে আলাদা

গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ-২৬ বিশেষ কারণেই অন্য যেকোনো বারের কপ সম্মেলন থেকে আলাদা। জলবায়ু পরিবর্তনে এই সম্মেলনে আন্তর্জাতিক মহল প্রতিশ্রুতি অথবা মুখের কথার চেয়ে সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। তারা বুঝাতে চেয়েছেন তর্কবিতর্ক অথবা শুধুমাত্র ডায়লগ কোন পরিবর্তন আনতে পারে না। সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়িত না হলে এই সম্মেলন ব্যর্থ। 

সম্মেলনের কনফারেন্স হলের বাইরে বিশ্রামহীনভাবে বিক্ষোভরত আন্দোলনকারীদের কথাগুলো কান পেতে শুনতে পারেন। এছাড়াও কান পাততে পারেন বৈশ্বিক জলবায়ুর নিয়ে কাজ করা সেসব তরুণদের বজ্রকন্ঠে উচ্চারিত জলবায়ুর প্রতি ন্যায় বিচার নিয়ে তোলা শব্দে।  যাদের প্রচারণা বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলেছে। 

পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুর প্রতিনিধিদের কাছ থেকেও শুনতে পারেন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ইতিমধ্যেই কিভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। এবং কিভাবে তাদের জীবন এবং জীবিকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাড়তে শুরু করেছে। 

এমন প্রেক্ষাপটে যে প্রশ্নটি সর্ব মহলের উত্থাপিত হচ্ছে, বিস্ময়ের সঙ্গে যে প্রশ্নটি আমাদের বাকরুদ্ধ করেছে তা হল, কপ সম্মেলনে বিশ্ব নেতাদের প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর করার ঐক্যমত, বিশ্বজুড়ে আলোচিত জলবায়ু পরিবর্তন ও দক্ষিণ মেরুর এমন পরিস্থিতি দেখেও "আমরা তাহলে কী করছি?"

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের উপর আন্তঃসরকারি প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা IPCC এর সর্বশেষ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কপ-২৬ এ অভিযোজন এবং এর অর্থায়নের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জাতিসংঘের সুনির্দিষ্ট একটি কমিটি প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদানের বিষয়ে রিপোর্ট করবে। এবং ২০২৪ সালে আবারও আলোচনা হবে।

কপ-২৬ জলবায়ুর দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ নিম্ন-আয়ের দেশগুলির জন্য জলবায়ু অর্থায়নের সর্বোচ্চ প্রতিশ্রুতির সাক্ষী হয়ে থাকবে। যার পরিমাণ প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।  সেইসাথে আরো ২৩২ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতিও থাকছে। এক বছরে যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। আর এই তহবিল গঠিত হবে সকল উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের নিজস্ব অর্থায়নে। 

বাংলাদেশের জন্য গত বছরের কপ-২৬ সম্মেলন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের অনড় অবস্থান ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে বলেছে যে, যেসব দেশ সবচে' বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে সেসব রাষ্ট্রে জাতীয়ভাবে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন করতে হবে।

সেই সম্মেলনে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কমানোর পক্ষে বার্ষিক ১.০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রতিশ্রুত তহবিল গঠনের জন্য এবং এর অর্ধেক অভিযোজন ও প্রশমনের জন্য বরাদ্দ করার বিষয়ে উন্নত দেশগুলোকে আহ্বান জানায়।

সিভিএফ -এর চেয়ার হিসেবে বাংলাদেশ ক্রমাগত উন্নত দেশগুলোকে সাশ্রয়ী মূল্যে পরিচ্ছন্ন ও সবুজ প্রযুক্তি প্রদানের মাধ্যমে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে অনুরোধ করছে। 

এছাড়াও ক্রমবর্ধমান সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, লবণাক্ততা, নদীভাঙন, বন্যা এবং খরার কারণে বাস্তুচ্যুত অভিবাসীদের জন্য বৈশ্বিক দায়িত্ব ভাগাভাগি করার বিষয়েও বাংলাদেশ গ্লোবাল ফোরামে গুরুতারোপ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্যতম সক্রিয় দেশ হয়ে উঠেছে। 

বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ০.৩৫ শতাংশেরও কম অংশ বাংলাদেশের, তবুও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ। এমন একটি আর্থিক কাঠামো গ্রহণ করার মাধ্যমে যা অভিযোজন বিনিয়োগের দিকে আরও সংস্থান চ্যানেলের জন্য সাজানো করা হয়েছে। 

একই সঙ্গে, নতুন পরিবেশগত নির্দেশিকাগুলি গ্রীণ ইকোনমী, গ্রীণ ব্যাঙ্কিং এবং দান তহবিল প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ সবুজ জলবায়ু তহবিলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে অনুদান পাওয়ার বিষয়েও আগ্রহী। 

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরো একটি উদ্যোগ হলো, একটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব ব্যবস্থা এবং ক্ষয়ক্ষতির জন্য একটি জাতীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক সচেতনতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চলছে, যেখানে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (বিসিসিটিএফ) এর অধীনে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রিজার্ভ ফান্ড  প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

কপ-২৬ বাংলাদেশের এবং এখানকার শিশুদের ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুরক্ষিত উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ার সেরা সুযোগ। হয়তো সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এটাই চূড়ান্ত সুযোগ। যেহেতু পুরো পৃথীবি কোভিড-১৯ মহামারী থেকে ভালোভাবে আবারো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে তাই এবার আমাদের সকলকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করার এই ঐতিহাসিক সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে। আমাদের এই পৃথীবিকে আরও বাসযোগ্য ও সবুজায়ন করতে হবে। 

বাংলাদেশ সেই দেশগুলির মধ্যে একটি যেগুলি জলবায়ুর প্রভাব থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। চিহ্নিত মৌলিক সমস্যা মোকাবেলার প্রয়াসে জলবায়ু আলোচনা বাংলাদেশের জন্য একটি আশীর্বাদ ও কার্যকরী হিসাবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, এটা বলাই যায়। এই ধরনের উৎসাহব্যঞ্জক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ সরকারের জলবায়ু আলোচনা আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও ইচ্ছে প্রকাশ কার হয়নি বা বিশেষ আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় নি। মানবসৃষ্ট এই সমস্যা একবিংশ শতাব্দীর মানুষের কাছে তার অসংখ্য চেহারা ইতিমধ্যে প্রমাণ হিসেবে সামনে এনেছে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণ করতে চাইলে বা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চাইলে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। শুধুমাত্র ক্ষতি সাধন করে এমন বিষয় নয়, যা এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করতে পারে তা নিয়েও ভাবতে হবে। 

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় "বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান" বা বিসিসিএসএপি- এর উন্নয়নের মাধ্যমে জলবায়ু মোকাবেলার বিষয়টি জোরদার করেছে। 

এই সংস্থাটি জলবায়ু পরিবর্তনের নানাদিক নিয়ে জাতীয় ও অভ্যন্তরীণ বিশেষজ্ঞদের সাথে ফলপ্রসূ আলোচনা করে আসছে। বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (বিসিসিএসএপি) হল একটি জ্ঞান কৌশল যা ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্রোগ্রাম অফ অ্যাকশন ২০০৫ এর উপর নির্মিত।

বিসিসিএসএপি বিশেষভাবে ছয়টি কৌশলগত ক্ষেত্র নির্ধারণ করে কাজ করছে। সেগুলো হলো, খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাপক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো, গবেষণা ও জ্ঞান ব্যবস্থাপনা, প্রশমন এবং কম কার্বন নি:সরণ। 

এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে মধ্যে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী ৪৪টি প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। 

ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্রোগ্রাম ফর অ্যাকশন (এনএপিএ) জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে বাংলাদেশে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পরিবর্তনের পূর্বাভাস তুলে ধরেছে।

বাংলাদেশ এমন একটি মধ্যপন্থী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে, যার মূল বিষয় হলো সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব সে হিসেবে সবার বিশেষ করে জাতিসংঘে ব্যাপক নির্ভর করে। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মোকাবেলায় কূটনৈতিক ভাষার সর্বোত্তম ব্যবহার করে বাংলাদেশ  লক্ষণীয় প্রচেষ্টা অব্যহত রেখেছে। বাংলাদেশের উচিত "সমান পরামর্শ, পারস্পরিক সুবিধা এবং অভিন্ন উন্নয়নের ভিত্তিতে এই বিষয়ে সহযোগিতা জোরদার করার চেষ্টা করা। বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। 

২০৪১ সালের মধ্যে  ধনী দেশ হওয়ার যে স্বপ্ন বায়লাদেশ দেখেছে তা অর্জনের জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই নাগরিক ও বাস্তুতন্ত্রের জন্য  পরিকল্পনা এবং পরিষেবা সরবরাহের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। 

২০১৮ এর ১৪ মে মন্ত্রিসভা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে "পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রালয়" হিসেবে ঘোষণা করে। এটি ছিল লক্ষনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মোকাবেলায় কূটনৈতিক অধিভুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করার জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টা লক্ষণীয়।

উন্নত দেশগুলিকে ওয়াদাকৃত ১ বিলিয়ন ডলারের তহবিল স্থাপনে রাজি করার জন্য বাংলাদেশের উচিত অবিরামভাবে এডভোকেসি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। সিভিএ-এর চেয়ার হিসেবে বাংলাদেশকে অতীতের মতো একই বার্তা উন্নত দেশগুলোর কাছে পৌঁছে দিতে হবে, যে সাশ্রয়ী মূল্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে পরিচ্ছন্ন ও সবুজায়ন প্রযুক্তি ভাগাভাগি করে নিতে হবে। সারা পৃথীবি জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত অভিবাসীদের কল্যাণে বাংলাদেশকে অবশ্যই সমর্থন দিয়েই যেতে হবে।

 

মূল, ড. তারিকুল ইসলাম
সহযোগী অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

অনুবাদ, সুফিয়ান ফারাবী
সরকার ও রাজনীতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়